
বিজ্ঞানের যে কোন গবেষণা বৈজ্ঞানিক কার্যপদ্ধতি মেনে হয়। এর ধাপগুলো হল—
-
বিষয় নির্ধারণ:
বিষয় নির্ধারণ বলতে কিছু গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ বোঝানো হচ্ছে না, বরং নির্দিষ্ট কোন প্রশ্ন করাকে বোঝানো হচ্ছে। যেমন ধরো “পানির স্ফুটনাঙ্ক” গবেষণার বিষয় নয়। “পানির স্ফুটনাঙ্কের উপর ফিটকিরি-এর ঘনমাত্রার প্রভাব” এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। তাই শুরুতে এরকম নির্দিষ্ট কোন প্রশ্ন খুঁজে নিতে হবে যার উত্তর এই গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া যাবে বলে তুমি মনে কর।
তবে একটা সমস্যা হচ্ছে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে করার মত মৌলিক গবেষণা খুব কম । এটা তোমরা যেমন জানো আমরাও জানি। একারণে বিজ্ঞান কংগ্রেস করতে হলে যে মৌলিক কাজই করতে হবে এমন না। মৌলিক কিছু করতে পারলে খুবই ভালো। না পেলেও কোন সমস্যা নেই। সায়েন্টেফিক মেথড অনুসরণ করলেই সেটা একটা সুন্দর গবেষণা হতে পারে। আবার অন্যদের করা কোন গবেষণা তুমি অন্য পদ্ধতিতে পরীক্ষা করেও দেখতে পারো। -
গবেষণার আগের গবেষণা (ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ):
এই ধাপটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সব বিষয়েই কেউ না কেউ কোন না কোন গবেষণা করে রেখেছেন। সুতরাং তাদের গবেষণার ফলাফল জানতে পারলে তোমার রিসার্চের জন্যই ভালো। একারণে তোমার বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। গুগল, উইকিপিডিয়া সার্চ করে প্রচুর তথ্য পেতে পারো, তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে ইউনিভার্সিটি লেভেলের টেক্সটবুক। আর সব ধরণের গবেষণা সম্পর্কে জানতে রিসার্চ পেপার পড়তে হবে। রিসার্চ পেপার খুজে পেতে scholar.google.com হচ্ছে আদর্শ জায়গা। এখানে তোমার বিষয়টা লিখে সার্চ করলেই প্রচুর পরিমাণে গবেষণাপত্র চলে আসবে। গবেষণাপত্র একটু কাটখোট্টা ভাষায় লেখা থাকে। তাই শুরুতে বেশ সমস্যা হবে। কিন্তু অভ্যাসটা হয়ে গেলে আজীবন কাজে লাগবে।
তবে দুঃখের বিষয় হলো, এসময়েই দেখা যাবে হয়ত তুমি যেই গবেষণা করতে চাচ্ছো হুবহু একই গবেষণা অন্য কেউ করে রেখেছে এবং এরকমটা হওয়াই স্বাভাবিক। -
হাইপোথিসিস:
পড়াশোনা শেষ হলে হাইপোথিসিস দাড়া করাতে হবে। অন্য গবেষকদের গবেষণা এবং পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান থেকে তোমাকে তোমার রিসার্চের ফলাফল কী হতে পারে সেটা অনুমান করতে হবে। এই অনুমানের সাথে পরবর্তীতে তোমার পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে দেখতে হবে। ধরো, অন্যদের করা কাজ থেকে তোমার মনে হল ফিটকিরি দ্রবীভূত থাকলে পানির স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যাবে এবং ফিটকিরির ঘনমাত্রা এবং স্ফুটনাঙ্ক হবে সমানুপাতিক। এটা এই গবেষণায় হাইপোথিসিস হতে পারে। প্রজেক্টের ক্ষেত্রে “তোমার তৈরি যন্ত্র দ্বারা কোন বাস্তব সমস্যার সমাধান হবে” সাধারণত এরকমটা তোমার হাইপোথিসিস হতে পারে।
তবে খেয়াল রাখতে হবে তোমার হাইপোথিসিস যেন কোন প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের বিরোধী না হয়। যেমন আমরা থার্মোডিনামিক্সের সূত্রগুলো বেশ ভালো করে জানি এবং কোটি কোটি পরীক্ষা দ্বারাও প্রমাণিত। সুতরাং “অবিরাম গতিযন্ত্র”-টাইপ কিছু তোমার গবেষণার বিষয় বা অনুসিদ্ধান্ত হতে পারবে না। -
পরীক্ষার পরিকল্পনা (এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন):
এবার পরীক্ষার পরিকল্পনা। পরিকল্পনা এমন ভাবে করতে হবে যেন প্রতিটি ফ্যাক্টরের প্রভাবকে আলাদা আলাদা ভাবে পরীক্ষা করা যায়। আদর্শ গ্যাসের সমীকরণ PV=nRT চিন্তা করো। এখানে চলক হচ্ছে P (Pressure বা চাপ), V (Volume বা আয়তন), n (Mole Number মোল সংখ্যা), T (Temperature বা তাপমাত্রা)।
সুতরাং অন্তত চার সেট পরীক্ষা করতে হবে যার প্রতিটি একটি করে চলকের প্রভাব বুঝতে সহায়তা করবে। আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যত বেশি পরীক্ষা করা হয় ফলাফল তত নিঁখুত হবে। -
পরীক্ষা:
এবার পরীক্ষণ এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে পরীক্ষা গুলো করতে হবে। এক পরীক্ষা একাধিক বার করতে হতে পারে। কেননা “কোন পরীক্ষা মাঝপথে গণ্ডগোল করায় বাদ দিতে হবে” এটাই স্বাভাবিক; গণ্ডগোল না হওয়াই অস্বাভাবিক। তাই এই ধাপটা খুব ধৈর্য ধরে করতে হবে। সাথে প্রচুর ডাটা নিতে হবে। যত বেশি ডাটা হবে পরীক্ষার ফলাফল বের করাও তত সহজ হবে। পরীক্ষার ক্ষেত্রে মাপজোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সঠিক যন্ত্র ব্যাবহার করে যথাসম্ভব নিঁখুত মাপ নিতে হবে। যেমন, গলনাঙ্কের উপর ফিটকিরির প্রভাব মাপতে বেশি ফিটকিরি দিলে কম তাপমাত্রায় ফুটবে কি না সেটা বের নোট করার নাম পরীক্ষা নয়। বরং স্বীকৃত এককে কোন ঘনমাত্রার জন্য কত তাপমাত্রাতে পানির স্ফুটন শুরু হলো সেটা নোট করতে হবে। -
উপাত্ত বিশ্লেষণ (ডেটা এনালাইসিস):
এটা আরেকটা কষ্টকর কাজ। উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কোন সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায় কি না। স্ট্যাটিসটিক্স একটু আধটু জানা থাকা ভালো। আবার মাইক্রোসফট এক্সেল, গুগল চার্ট, ডেসমস ইত্যাদি বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করেও খুব সহজে ডাটা এনালিসিস করা যায়। ফলাফলগুলোকে বিভিন্ন চার্ট/গ্রাফ আকারে প্রকাশ করলে বুঝতে সুবিধা। এ কারণে সেভাবে প্রকাশ করতে হবে। যেমন স্ফুটনাঙ্কে ফিটকিরির প্রভাবের গবেষণাতে x অক্ষে ঘনমাত্রা এবং y অক্ষে স্ফুটনাঙ্ক নিয়ে গ্রাফে বিন্দু বসানো যেতে পারে। এরপর এই বিন্দুগুলোর মধ্য দিয়ে এক্সেল/অনলাইন গ্রাফিং ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করে best fit line অথবা best fit curve এঁকে দিতে হবে। -
ফলাফল:
এবার তোমার পরীক্ষার ফলাফল হাতে চলে এল। এখন তোমার ফলাফলকে তোমার হাইপোথিসিসের সাথে মিলিয়ে দেখ। হাইপোথিসিস সম্পূর্ণ না মেলাই স্বাভাবিক। ধরো স্ফুটনাঙ্ক আসলেই ফিটকিরির ঘনমাত্রার সাথে সাথে বূদ্ধি পেল; কিন্তু সরলরেখা হলো না। কিন্তু তাতে কোনই সমস্যা নেই। কেননা তুমি এখন সঠিক তথ্যটি জানো। এবং তোমার রিসার্চের লক্ষ্যই হলো সঠিক তথ্যটি জানা, হাইপোথিসিসকে সত্য প্রমাণ করা নয়। - গবেষণার পরে গবেষণা:
নিখুঁত গবেষণা বলতে কিছু নেই। তোমার গবেষণায় যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, ফলাফল কেন আকাঙ্ক্ষিত হয় নি, আবার করতে চাইলে কীভাবে করবে এগুলো লিখতে হবে। তোমার হাইপোথিসিস যদি না মিলে তবে কেন মিলল না তার ব্যাপারে মন্তব্য লিখতে পারো। তোমার এই গবেষণা হতে পারে অন্য কারো ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চের অংশ। অন্য কেউ যেন এটা পড়ে নতুন গবেষণা করতে পারে এমন ভাবে গবেষণাটি লিখতে হবে। এমন কোন আইডিয়া থাকলে সেটাও লিখে ফেলতে পারো।
এখানে বৈজ্ঞানিক কার্যপদ্ধতিকে যেভাবে বর্ণনা করা হলো সেটা এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের জন্য। কিন্তু যদি কেউ থিওরেটিক্যাল কাজ করতে চায়? অথবা ধরা যাক গণিতের কিছু নিয়ে কাজ করতে চায়? সেক্ষেত্রে হাইপোথিসিস থেকে পরীক্ষণ পর্যন্ত অংশগুলোর বদলে গাণিতিক প্রক্রিয়া বিস্তারিত ভাবে দেখাতে হবে। সম্ভব হলে ডাটা এনালিসিস অংশে এই সূত্র / থিওরেমকে আগের কোন গবেষণার ফলাফল বা random কোন পরিস্থিতি দিয়ে টেস্ট করিয়ে দেখাতে হবে।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা সাধারণত যেই ভুলটুকু করে সেটি হল, তারা গতানুগতিক সায়েন্স প্রজেক্টের বিষয় নির্ধারণ করে এবং একটু পড়াশোনা করে হাইপোথিসিস দাঁড় করায়, এরপর মাঝের ধাপ বাদ দিয়ে হাইপোথিসিসকে ফলাফল হিসেবে ঘোষণা করে সেটাকেই সায়েন্স ফেয়ারে প্রজেক্ট আকারে প্রকাশ করে দেয়। তাহলে বুঝতে পারছো কেন এগুলোকে বিজ্ঞান-গবেষণা বলে স্বীকৃতি দেয়া হবে না?
লেখক—
ইশতিয়াক হোসেন আকিব
বিজয়ী, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৩
বিজয়ী, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৪
বিজয়ী, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৫
পেপার অফ দা কংগ্রেস, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৬